কথাসাহিত্যিক হাসান আজিজুল হক ‘নিরপেক্ষ সাংবাদিকতা: মায়া-প্রপঞ্চ’ শিরোনামে একটি প্রবন্ধ লিখেছিলেন। যাঁরা সাংবাদিকতাকে নিরপেক্ষ বা বস্তুনিষ্ঠ পেশা হিসেবে দেখতে অভ্যস্ত, তাঁদের জন্য প্রবন্ধটি চোখ খুলে দেওয়ার মতো। সাংবাদিকদের ক্ষমতার সখ্য দেখে হাসান আজিজুল হকের প্রবন্ধের হীরকোজ্জ্বল শব্দরাশি চোখের সামনে ভেসে উঠছে। তিনি লিখেছেন—
‘সমাজে সর্বস্তরের মানুষ নির্লজ্জ আপস করবে, জীবিকার জন্য, চাকরির ভয়ে প্রতিমুহূর্ত হেঁটমস্তক করে, আর সাংবাদিকরাই নির্ভীক, সৎ এবং সত্যনিষ্ঠ থাকবে, এ রকম দাবি অন্যায় আবদার ছাড়া আর কিছুই নয়।...নির্ভীক সাংবাদিকতা বিচ্ছিন্নভাবে চর্চার বিষয় নয়। সমাজ সংগঠনের গাঁটে গাঁটে দুর্নীতি, স্বজনতোষণ, কর্মহীনতা, হিংস্র দারিদ্র্য এবং তামসিক শোষণের ব্যবস্থা থাকলে...সাংবাদিকও স্বধর্মচ্যুত হয়ে...কোনো রকমে দিন গুজরানোর চেষ্টা করেন।’ অমোঘ উচ্চারণ। অত্যন্ত রূঢ় বাস্তবতা।
কেবল জীবন-জীবিকার তাগিদে সাংবাদিকেরা স্বধর্মচ্যুত, এমনটি নয়। ক্ষমতার সঙ্গে সখ্যপ্রিয়তা সাংবাদিকদের স্বধর্মচ্যুত করে। সাংবাদিকেরা রাখঢাক না রেখে ক্ষমতা ও এস্টাবলিশমেন্টের সঙ্গে পারস্পরিক স্বার্থের সম্পর্ক গড়ে তুলতে তৎপর হয়ে উঠছেন, যা রুগ্ণ বাস্তবতা তৈরি করছে।
২৪ জুলাই প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার সঙ্গে দেশের শীর্ষস্থানীয় সাংবাদিকদের মতবিনিময় সভায় দেশের একজন প্রবীণ সাংবাদিক বলেন, ‘শেখ হাসিনার সঙ্গে আছেন, প্রয়োজনে যেকোনো কিছু করতে প্রস্তুত’ (সূত্র: প্রথম আলো, ২৪ জুলাই ২০২৪)। এ বক্তব্য সাংবাদিকদের সঙ্গে ক্ষমতার পারস্পরিক স্বার্থের সম্পর্ক আরও স্পষ্ট করে তুলেছে। এডিটরস গিল্ডের উদ্যোগে এ আয়োজনে বিভিন্ন গণমাধ্যমের সম্পাদক, জ্যেষ্ঠ সাংবাদিক ও হেড অব নিউজ উপস্থিত ছিলেন।
একইভাবে ২৭ জুলাই ২০২৪ মুক্তিযুদ্ধের চেতনার সাংবাদিক ফোরাম কোটা সংস্কার আন্দোলনকালে হত্যাকাণ্ড ও অগ্নিসংযোগের তীব্র নিন্দা জানিয়ে দেশের স্বাভাবিক অবস্থা ফিরিয়ে আনতে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার গৃহীত পদক্ষেপের প্রতি পূর্ণ সমর্থন জানিয়েছেন (সূত্র: প্রথম আলো, ২৮ জুলাই ২০২৪)।
ক্ষমতাপ্রীতি সাংবাদিকতায় একটি রোগ হয়ে দাঁড়িয়েছে। সাংবাদিকেরা যদি ‘প্রয়োজনে যেকোনো কিছু করতে প্রস্তুত’ থাকেন অথবা ‘গৃহীত পদক্ষেপের প্রতি পূর্ণ সমর্থন’ দেন, তবে ক্ষমতা ও সাংবাদিকতার মধ্যে বিভেদরেখা টানা কঠিন হয়। সাংবাদিকতা হলো নির্মোহ বিশ্লেষণ, বস্তুনিষ্ঠ ও নিরপেক্ষ উপস্থাপনা।
সাংবাদিকতা পেশার অভিমুখীনতা হলো কোনো বিষয় অনুপুঙ্খভাবে দেখা; সত্য যাচাই (ফ্যাক্টচেক), সত্যকে কল্পকাহিনি (ফিকশন) থেকে আলাদা ও নির্মোহভাবে তা উপস্থাপন করা।
সংবাদমাধ্যমের কাজ বিশ্লেষণাত্মক, যুক্তিশীল, অন্তর্ভুক্তিমূলক সহনশীল সমাজ গড়ে তুলতে সহায়তা করা। কারণ, গণতন্ত্রের জন্য প্রয়োজন তথ্যসমৃদ্ধ জনসমাজ। একটি বিশ্লেষণাত্মক সমাজ গড়া না গেলে গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠা পাবে কোথা থেকে? ক্ষমতা ও শাসন চোখে চোখে রাখা সাংবাদিকতার প্রধান কাজ। কারণ, ক্ষমতা ও কর্তৃত্বের ব্যবহার ও অপব্যবহার এক জনস্বার্থমূলক বিষয়।
অনেকের কাছে সাংবাদিকতা এখন একটি উপলক্ষমাত্র। বিত্তবৈভব, ক্ষমতা অবস্থান ধরে রাখার বিশেষ কৌশল। সমকালীন সাংবাদিকতার ক্ষয়-ক্ষরণ কারও অদেখা বা অজানা নয়? অরুন্ধতী রায় যেমনটি বলেন, ‘একবার কেউ কিছু দেখে ফেললে, তাকে অদেখা বানানো যায় না।’ ঠিক একইভাবে একবার কেউ কিছু শুনে ফেললে, তাকেও না-শোনা করা যায় না।
সাংবাদিকেরা ক্ষমতার কেন্দ্রে গিয়ে কী করেন, মানুষ তা দেখছে। বাংলাদেশের সাংবাদিকতা এক প্রশ্নহীন সময় পার করছে। এ প্রশ্ন হলো ক্রিটিক্যাল প্রশ্ন, মানের প্রশ্ন। সাংবাদিকতায় গুরুত্বপূর্ণ বিষয়, প্রশ্ন করার সক্ষমতা ও সাহস। ক্ষমতার সঙ্গে সখ্যপ্রিয়তার কারণে মান প্রশ্ন আসছে না, বরং আসছে স্তুতি ও স্তুতির কোরাস।
সাংবাদিকতার জন্য প্রিসিশন সেন্স বা সূক্ষ্মবোধ থাকতে হয়। অল্পকথায় নির্ভুলভাবে মূল প্রশ্নটি বা ইস্যু উপস্থাপন করতে হয়। সাংবাদিকেরা প্রশ্ন করতে সময় বেশি ব্যয় করেন, অনেক ক্ষেত্রে প্রশ্ন গুলিয়ে ফেলেন, আগাম প্রস্তুতি থাকে না। ক্ষমতার কাছাকাছি গেলেই একশ্রেণির সাংবাদিকের মধ্যে বিগলিত ভাব চলে আসে। সাফাই গান। অথবা এমন প্রশ্ন করেন, যার ভেতর প্রত্যাশিত উত্তর থাকে। সাংবাদিকতার ধারণা যথেষ্ট পোক্ত না হলে ক্ষমতার তাপ সাংবাদিকদের নির্বিষ করবেই। অনেকে নির্বিষ হয়ে পড়ছেন।